তোকমা দানায় ১১টি সমস্যার সমাধান ও খাওয়ার নিয়ম

তালমাখনা খাওয়ার ১২ টি উপকারিতাতোকমা দানা আমাদের শরীরের জন্য অতি উপকারী একটি খাদ্য উপাদান। এর পুষ্টিগুণ আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের কাছে তোকমা দ্বারা বেশ পরিচিত। পুষ্টিগুণে ভরপুর তোকমা দানা আমাদের শরীরে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় তোকমা দানার ব্যবহার সবচাইতে বেশি।
তোকমা দানা খাওয়ার উপকারিতা
এ পোষ্টের মাধ্যমে আমরা তোকমা দানায় ১১টি সমস্যার সমাধান ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি সুতরাং এই বিষয়গুলি সম্পর্কে জানতে পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।

ভূমিকাঃ


স্বাস্থ্যকর খাবারগুলির মধ্যে তোকমা দানা অন্যতম একটি। এটি প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার। তোকমা দানা সালভিয়া হিসপানিকা নামেও পরিচিত। বিভিন্ন ফলের জুস এবং ফালুদা তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়। প্রচন্ড গরমে কালো দানা দানাদার এই বীজের শরবত আমাদের প্রশান্তি দেয়। সেই সঙ্গে পেটের বিভিন্ন অসুখ থেকে আমাদের মুক্তি দেয়।
পুষ্টিগুনে ভরপুর তোকমা দানায় রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এছাড়াও ওমেগা-৩ এবং ফ্যাটি এসিডের অন্যতম একটি ভালো উৎস হল তোকমা দানা।আমাদের শরীরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান আছে তোকমা দানায়।

তোকমা দানার পরিচয়ঃ


তোকমা দানা একপ্রকার গুল্ম জাতীয় সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই গাছের আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে। এটি উচ্চতায় সাধারণত ১ থেকে দেড় মিটার হয়ে থাকে। এর ফুল হয় বেগুনি বা গোলাপি রঙের। তোকমা দানার বীজ টি হয় ডিম্বাকৃতির মত।বীজ বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে যেমন বাদামী, কালো এবং সাদা। 
তোকমা দানায় রয়েছে হাইড্রোফোলিক উপাদান যার ফলে এটি খুব সহজে পানি শোষণ করে নেয়। তোকমা দানা তার ওজনের চেয়ে ১২ গুণ বেশি পানি শোষণ করতে পারে।

তোকমা দানার পুষ্টিগুণঃ


তোকমা দানা হল একটি আদর্শ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম তোকমা দানায় পর্যাপ্ত পরিমাণে লৌহ, ক্যালসিয়াম, থেয়ামিন, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, ফসফরাস, ভিটামিন বি, রিবোফ্লাভিন ও ফোলেইট রয়েছে। তোকমা দানায় পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম তোকমা দানায় ৪০ গ্রাম আঁশ পাওয়া যায় যা হজমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তোকমা দানাই আমাদের শরীরের প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩০ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজ এবং ১৮% ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।

তোকমা দানায় ১১টি সমস্যার সমাধানঃ


ওজন কমাতে সহায়তা করেঃ আমাদের শরীরের জন্য তোকমা দানা অনেক উপকারী এবং ওজন কমাতে যথেষ্ট কার্যকরী একটি খাদ্য উপাদান। তোকমা দানাতে আলফা- লিনোলেনিক অ্যাসিড থাকে যা শরীরের ওজন কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা পেটে ভরাট ভাব তৈরি করে রাখে। যার ফলে কম খাওয়া হয় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফাইবার জাতীয় খাবার পেটের চর্বি কমাতেও সহায়তা করে।

হজমে সহায়ক তোকমা দানাঃ তোকমা দানা হজমে যথেষ্ট সহায় হোক কারণ তোকমা দানায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা খাদ্যকে দ্রুত হজমে সহায়তা করে থাকে। তোকমা দানা নিয়মিত খেলে গ্যাস্ট্রিক আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ও আমাশয় এর মত পেটের সমস্যাতেও সমাধান পাওয়া যায়। পেটের জ্বালাপোড়া ভাব এবং দেহের ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতেও যথেষ্ট কার্যকরী হবে তা পালন করে তোকমা দানা।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করেঃ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে তোকমা দানার শরবত বেশি উপকারী। পানি কম খাওয়ার কারণে অথবা কোন কারণে যদি কোষ্ঠকাঠিন্য হয় তবে তোকমা দানা পানিতে মিশিয়ে খেলে খুব সহজে সমাধান পাওয়া যায়। তোকমা দানায় থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্ভাবনা হ্রাস করে এবং তন্ত্রের সুস্বাস্থ্য ধরে রাখে। এটি হজমের সমস্যা সমাধানেও খুব কার্যকর।

গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করেঃ তোকমা দানা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতে বেশ কার্যকরী।যদি কেউ নিয়মিত তোকমা দানা পানির সাথে মিশিয়ে খান তবে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। এটি শুধু গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় সমাধান করেনা এটি পেটের অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করে পেটের জ্বালাপোড়া ভাবো দূর করে।

ঠান্ডা জনিত সমস্যার সমাধানেঃ আমরা অনেকেই ঠান্ডা জড়িত সমস্যায় ভুগে থাকে। একটু আবহাওয়া চেঞ্জ হলে বা অল্প ঠান্ডাতেও আমাদের সর্দি-কাশির মতো সমস্যায় পড়তে হয়। তোকমা দানা আমাদের স্পাসাম্যাটিক পেশিগুলোকে প্রশমিত করে শিথিল করতে সহায়তা করে যার ফলে ঠান্ডা জড়িত সমস্যায় সমাধান পাওয়া যায়। এছাড়াও তোকমা দ্বারা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

ত্বক ও চুলের যত্নে তোকমা দানাঃ ত্বক ও চুলের যত্নে তোকমা দানা বেশ কার্যকর। ত্বকের সমস্যার সমাধানেও তোকমা দানার যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে। নারিকেল তেলের সাথে তোমার দানা বীজ চূর্ণ করে একসঙ্গে মিশিয়ে ত্বকে লাগালে চর্মরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তোকমা দানায় থাকা ভিটামিন কে আয়রন এবং প্রোটিন চুলের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ তোকমা দানা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। তোকমা দানা হল ফ্ল্যাভনয়েড ও ফেনোলিক উপাদান সমৃদ্ধ যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও হার্ট ভালো রাখতে এবং শরীরের জন্য উপকারী কোলেস্টেরল উৎপন্ন করতে বেশ কার্যকরী তোকমাদানা।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেঃ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে তোকমা দানা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি দেহের বিপাকের গতিধীর করে দেয়। কার্বসকে গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে ফলে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জানা যায় তোকমা দানা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরী।

রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করেঃ তোকমা দানা রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জানা যায় তোকমা দানা শরীরের জন্য উপকারী কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে এবং রক্তে চর্বির পরিমাণ কমায়। ফলে হার্ট সুস্থ থাকে।

উদ্ভিদ ভিত্তিক ওমেগা-৩ উৎসঃ ওমেগা-৩ আমাদের শরীরের জন্য খুবই দরকারি একটি উপাদান। উদ্ভিদভিত্তিক ওমেগা এসিডের সবচেয়ে ভালো উৎস হচ্ছে তোকমা দানা। সুতরাং ওমেগা-৩ অভাবে আমাদের শরীরে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় সেটা খুব সহজে আমরা রোধ করতে পারি নিয়মিত তোকমা দানা খাওয়ার মাধ্যমে।

শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করেঃ প্রচন্ড গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে তোকমা দানার শরবত। প্রচন্ড গরমে ডিহাইড্রাশন এর সমস্যা যেন না হয় তার জন্য তোকমা দানা শরবত খাওয়া যেতে পারে। দেহের তাপমাত্রা কমাতে এটি খুব কার্যকর।

তোকমা দানা খাওয়ার নিয়মঃ

তোকমা দানা খাওয়ার নিয়ম বেশ সোজা। তবে ন্যূনতম কিছু নিয়ম মেনে তোকমা দানা খেলে আমরা সবাই বেশ উপকৃত হব। সর্বোচ্চ উপকারিতা পেতে তাই আমাদের উচিত নিয়ম মেনে তোকমা দানা খাওয়া।
  • সাধারণভাবে তোকমা দানা কে অর্থাৎ তোকমার বীজগুলোকে আপনি পানির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
  • তোকমা দানা গুলোকে পানিতে মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে এবং দেখতে হবে দানাগুলো ভিজে ফুলে উঠেছে এবং এগুলোর ভিতর পানি ঢুকে গিয়েছে তখন এটা খাওয়া যাবে।
  • তোকমা দানার সাথে বাদাম মিক্স করে ব্লেন্ড করে নিতে হবে এবং এই ব্লেন্ড করা গুড়া পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে খাওয়া যাবে।
  • তোকমা দানা পানিতে ভেজানোর পরে সাথে অল্প একটু দুধ এবং মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।
  • তোকমা দানা ও ইসবগুলের ভুষি একসঙ্গে মিশিয়ে পানিতে ভিজিয়ে খেতে পারেন। স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এতে অল্প একটু লেবুর রস মিশিয়ে নিতে পারেন। সাথে একটু লবণও দেয়া যেতে পারে।
  • এছাড়া আপনি যদি শুধু পানির সাথে মিশিয়ে তোকমা দানা খেতে চান তবে এর সাথে অল্প একটু চিনি মিশিয়ে নিতে পারেন।
  • আপনি চাইলে শরবত আকারেও খেতে পারেন। শরবত তৈরির জন্য ২ চা চামচ তোকমা দানা, লেবুর রস ২ টেবিল চামচ, চিনি ২ টেবিল চামচ অথবা স্বাদমতো, গোলাপজল এক টেবিল চামচ এবং কয়েকটা পুদিনা পাতা নিয়ে এক গ্লাস পানিতে ২০ থেকে ২৫ ভিজিয়ে রাখুন। এরপর চামচ দিয়ে নেড়ে খেয়ে নিন।

তোকমা দানা খাওয়ার সময়ঃ


তোকমা দানা খাওয়ার উপযুক্ত সময় হচ্ছে সকাল। উপরে বর্ণিত যে কোন নিয়মে আপনি তোকমা দানা খেতে পারেন। তবে তোকমা দানা রাতে ঘুমানোর আগে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খেলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। এটি চাইলে আপনি প্রতিদিন খেতে পারেন। এটি পেটের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

তোকমা দানা খাওয়ার অপকারিতাঃ

প্রতিটা বিষয়েরই কিছু ভালো এবং কিছু খারাপ দিক থাকে। তোকমা দানা খাওয়ার উপকারিতার পাশাপাশি অল্প কিছু অপকারিতাও আছে। যেমন

  • গর্ভবতী মহিলাদের জন্য তোকমা দানা খাওয়া সমস্যার কারণ হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন নামক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন থাকে। কিন্তু যদি তাকে বেশি পরিমাণ তোকমা দানা খাওয়ানো হয় তবে এই হরমোনটির মাত্রা কমে যেতে পারে এবং এর ফলে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • শিশুদের তোকমা দানা থেকে দূরে রাখাই উত্তম। যেহেতু ছোট শিশুর পেটে খুব বেশি বিপাকীয় ক্ষমতা থাকে না তাই এটি তাদের জন্য ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও এটি শিশুদের পেটের সমস্যা আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে তোকমা দানা খেলে। এটি সব সময় পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদের সেবনের জন্য।

লেখকের মন্তব্যঃ

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় তোকমা দানা একটি অন্যতম পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান। ইউনানী ও চীনা মেডিসিনেও এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। তোকমা দানা স্থান ভেদে বিভিন্ন নামে মানুষের কাছে পরিচিত। উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা জানলাম তোকমা দানায় ১১টি সমস্যার সমাধান ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে।

আমরা যদি সঠিক নিয়ম মেনে তোকমা দানা খায় তবে এতে থাকা প্রচুর পরিমাণে আঁশ প্রোটিন এবং ক্যালোরি যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

প্রিয় পাঠক, তোকমা দানায় ১১টি সমস্যার সমাধান ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কিত এই পোস্টটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই পরিচিতদের মাঝে শেয়ার করে দিবেন এবং কোন মন্তব্য থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url